Looking For Anything Specific?

Header Ads

মুক্তচিন্তা ও বাংলাদেশ



বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণীর বিকাশ ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক কারণে তাদের প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক অনেক দেরিতে। এই শিক্ষিত শ্রেণীতে মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার ধারকদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। উনিশ শতকের শেষার্ধে জন্ম এমন কয়েকজন মনীষীকে ব্যতিক্রম বলা চলে।

এমনকি বিশ শতকের প্রথমদিকেও এদের বিকাশ ধীরে-সুস্থে। বৃহত্তর জনসমাজে সংস্কার ও রক্ষণশীলতার তখনও ব্যাপক প্রভাব।


বাঙালি সমাজের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠায় শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণীতে আত্মপরিচিতি ও আত্মবিকাশের প্রবণতা এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নান্দনিক দিকগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। যুক্তিবাদ, উদার মানবিকতা ও মুক্তচিন্তা চর্চার স্বাধীন প্রকাশ সীমাবদ্ধ বৃত্ত অতিক্রম করতে পারে না। দেলোয়ার হোসেন বা বেগম রোকেয়ার চেষ্টা তাই ফলপ্রসূ হয়নি।

এমন এক সামাজিক পরিবেশে সামান্য সংখ্যক বাঙালি মুসলমান তাদের সমাজে উদার মানবিক ও যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন কদাচিৎ কেউ মশাল হাতে, অন্যরা চকমকি ঠুকে। বিদ্রোহী কবি-সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম মশালধারীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। একদিকে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি (১৯২২), অন্যদিকে সামাজিক জড়তা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন নজরুল। পাশাপাশি সমাজ বদলের সাহসী উচ্চারণ নজরুলের, তার একান্তজন কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে।

সমাজ যে তখনও কতটা অন্ধকারে তার প্রমাণ মেলে 'শিখা' গোষ্ঠীর ঢাকাকেন্দ্রিক মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের (১৯২৬) বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়। এ গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন। সঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, তসদ্দক আহমদ প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের মানুষ। 'শিখা' পত্রিকার সাহসী স্লোগানটি দেখে মনে হয় তাদের মুক্তচিন্তার প্রেরণা হয়তোবা ফরাসি রেনেসাঁসীয় বোদ্ধাদের মতাদর্শ বা রবীন্দ্রনাথের 'জ্ঞান যেথা মুক্ত' ইত্যাদি বক্তব্য থেকে। অথবা নিতান্তই তাদের আত্মচিন্তা থেকে। কিন্তু ঢাকাই সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধ রক্ষণশীলতা মুক্তচিন্তার শিখায় পানি ঢালে এতটা উগ্রতায় যে, প্রাণ বাঁচাতে তাদের অকুস্থল ছেড়ে চলে যেতে হয়। সমাজ-সংস্কারের অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করে।


এসব চিন্তার ধারাবাহিকতায় হুমায়ুন কবির, এস ওয়াজেদ আলী, রেজাউল করিম প্রমুখের চেষ্টা ছিল পশ্চাৎপদ সমাজকে আলোকিত করে তোলার। তাদের সঙ্গে স্মরণযোগ্য কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সামাজিক অন্ধতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা।


উল্লেখ্য, তারা সাহিত্যের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিম মানসে মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন সামাজিক-রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে। অবশ্য তাদের কারও কারও চেষ্টা ছিল নিছক সাংস্কৃতিক বলয়ে, যেমন মোতাহের হোসেন চৌধুরী।

প্রসঙ্গত, সমাজকে অন্ধতা থেকে মুক্তি দিতে সদা তৎপর যে অসম সাহসী মানুষটি বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রবল বিরূপতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেছিলেন, তৃণমূল স্তরের সেই স্বশিক্ষিত মানুষটির নাম কদাচ উচ্চারিত হয়। তিনি হলেন অসাধারণ বলিষ্ঠ মনের অধিকারী প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি আরজ আলী মাতুব্বর। তার মধ্যে বিদ্যাসাগরীয় দৃঢ়তার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি উদ্যম হারাননি এবং মুক্তচিন্তার অসাধারণ বয়ানে তিনি ছিলেন আমৃত্যু সোচ্চার।


দুই

এখন প্রশ্ন, উলি্লখিত এদের এবং অনুলি্লখিত কারও কারও মুক্তচিন্তা ও অনুরূপ রচনাদির অসামান্যতা সত্ত্বেও শিক্ষিত মুসলমান সমাজের বৃহত্তর স্তরে তাদের আদর্শবাদের ছাপ কতটা পড়েছে, কতটা আলোকিত হয়েছে সমাজ, কতটা পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে মুক্তচিন্তার প্রকাশ।

এসব প্রশ্নের জবাব দিতে কোনো প্রকার জরিপ বা পরিসংখ্যানের সহায়তা মেলে না। দৃশ্যমান পরিস্থিতিই বাস্তবতার প্রকাশ ঘটায়। সে বাস্তবতার কারণ প্রথম পর্বে সমাজে ব্যাপক অশিক্ষা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা। দ্বিতীয় পর্বে রক্ষণশীল ও সংকীর্ণ রাজনীতি, পরে পাকিস্তানি রাজনীতির উন্মাদনাই মূল কারণ, যা মুক্তচিন্তা, প্রগতিচিন্তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

তবু এ কথা সত্য যে, এর মধ্যেই বাঙালি সমাজের নান্দনিক সাধনায় মানবিক ও প্রগতিবাদী মতাদর্শের প্রভাব পড়ে তরুণ ও যুব সমাজে। সেইসঙ্গে প্রভাব পড়ে বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বরাজনীতির প্রগতি চরিত্রের, হোক না তা পরোক্ষ ও সীমাবদ্ধ স্তরে। স্বভাবতই দেখা দিয়েছে মাতৃভাষাপ্রীতি, কিছু মাত্রায় সমাজ সচেতনতা এবং আধুনিকতার বোধ। এর মধ্যে রাজনীতির চেতনাও একেবারে অনুপস্থিত থাকেনি।

তাই পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গের তরুণ সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভাষা চেতনা ও সত্য প্রকাশের কিছুটা প্রবণতা দেখা গেছে আন্দোলনের মাধ্যমে। সেখানে সাহসের অভাব ছিল না। সে ধারায় ষাটের দশকে জাতীয়তাবোধ ও ভাষিক ভূখণ্ড প্রেমে মুক্তচিন্তার প্রকাশ একেবারে অনুপস্থিত ছিল না।

এর পুরোটাই ছিল পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক চরিত্রের। এর সামাজিক প্রকাশ যতটা দেখা গেছে তা ছিল আবেগ-উৎসারিত, সমাজবদলের চরিত্রজাত নয়। এবং তাও যতটা প্রত্যাশিত ছিল ততটা নয়। রাজনৈতিক প্রভাবের প্রবলতায় বৃহত্তর সমাজে মুক্তচিন্তার চর্চা সীমাবদ্ধ বৃত্তে আবদ্ধ থেকেছে। নান্দনিক আদর্শের চিন্তা পিছিয়ে পড়েছে। শিক্ষার সীমাবদ্ধতাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাজনৈতিক আবেগ যুক্তিকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তির চেয়ে ভক্তি প্রাধান্য পেয়েছে।

রাজনৈতিক মুক্তি ও ভাষিক ভূখণ্ড-স্বাধীনতা সবই ঘটেছে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। জাতিগত আলোড়ন তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ঘিরে। কিন্তু চিন্তাজগতে মননশীলতার চর্চা, যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার চর্চা পূর্বোক্ত রাজনৈতিক উন্মাদনার তালে পা ফেলে চলতে পারেনি, অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। ফলে আবারও বলি, মুক্তচিন্তার আদর্শ সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।



তিন

এ অবস্থায় চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে বিজয়ের উল্লাস। আবেগ বড় বেশি বেগবান হয়ে উঠেছিল। তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রই এ কথা স্বীকার করবেন। আবেগ ও যুক্তি অনেকটাই পরস্পরবিরোধী, যেমন ভক্তি ও যুক্তি। একাত্তর আমাদের যুক্তিবাদী চেতনা সামান্যই উপহার দিয়েছে। আমরা সবাই স্বাধীনতার আবেগে ভেসেছি, এমনকি যুক্তিবাদী প্রগতিবাদীরাও। ব্যতিক্রম সামান্য। তখন এমন একটি একদেশদর্শী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে যুক্তি দিয়ে বিচার-ভাবনার অবকাশ বড় একটা ছিল না। এখানেই ছিল মুক্তচিন্তার সীমাবদ্ধতা।

মুক্তচিন্তার সঙ্গে বাকস্বাধীনতার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এরা পরস্পরের পরিপূরক। মুক্তচিন্তা ও তার প্রকাশ সমাজে প্রভাব তৈরি করে অনুকূল পরিবেশে। একদেশদর্শী, উগ্র রাজনীতি সে অনুকূল পরিবেশের সহায়ক হয়ে ওঠেনি। তাই মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার পরিবেশ প্রত্যাশিত মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। সমাজও ছিল একই চরিত্রে ভাসমান।

পরবর্তীকালে নানা রাজনৈতিক ঘটন-অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়বাদী শক্তি এ অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগে সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের প্রচার ও প্রভাব ক্রমেই বেড়ে শেষ পর্যন্ত এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, তাতে মুক্তচিন্তার প্রকাশই শুধু ব্যাহত হয়নি, মৃত্যু ও রক্তে মুক্তচিন্তা তার আদর্শিক ঋণ শোধ করেছে, বলতে হয় মাশুল গুনেছে। এ সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের প্রতিক্রিয়া প্রতিকারহীনতায় পর্যবসিত।

এ ক্ষেত্রে প্রশাসন অনেকটাই অসহায়। মুক্তচিন্তার ভাবুক, লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক বা পেশাজীবীকে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের কারণে প্রাণ দিতে হচ্ছে। চলছে 'সিরিয়াল কিলিং' ধীরে-সুস্থে। প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়লেও অপরাধী শনাক্তের কাজ সহজ হচ্ছে না। বরং অজুহাত উঠছে ধর্মীয় অনুভূতির স্পর্শকাতরতা নিয়ে। এর সুবিধা পাচ্ছে রক্ষণশীলরা।

সংক্ষিপ্ত বিচারে বলতে হয়, সব মিলিয়ে সমাজে মুক্তচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। আতঙ্ক বিরাজ করছে মুক্তমনা সুধী মহলে। অবস্থা নিরসনের দায় রাষ্ট্রযন্ত্রের, সেইসঙ্গে সমাজের সচেতন অংশেরও তৎপরতায়, প্রতিবাদহীন জড়তায় নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্ব সমাজে বাংলাদেশের গণতন্ত্রী-যুক্তিবাদী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছেও। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুক্তি মিলবে না। তথ্যকে তথ্য দিয়ে, যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার সমাজ গড়ে ওঠে- প্রতিপক্ষকে হত্যায় নয়। এ সত্যে বাংলাদেশি সমাজকে বিশ্বাসী হতে হবে। তা না হলে সমাজের পশ্চাৎগতি বন্ধ হবে না।


লেখক: আহমদ রফিক

ভাষাসংগ্রামী

প্রাবন্ধিক


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ