বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র আছে অনেক।
কিন্তু মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র ও অর্জনের দিক থেকে সব ছবিকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে—তারেক
মাসুদের ‘মাটির ময়না’।এটি তার পরিচালিত প্রথম
পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তারেক মাসুদের গল্প
অবলম্বনে যৌথভাবে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন তারেক এবং ক্যাথরিন মাসুদ।
চলচ্চিত্রের মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নুরুল ইসলাম বাবলু,
রাসেল ফরাজী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম এবং লামিসা আর রিমঝিম।বিশ্বের
মোট ৩৫টি দেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায় ছবিটি।
ছবিটিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্কারের বিদেশি ভাষার ক্যাটাগরিতে লড়াইয়ের জন্য মনোনীত করা হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম ছবি হিসেবে অস্কার বিজয়ের জন্য মনোনীত হয় । অস্কারের শিকে না ছিঁড়লেও বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় তিনটি ক্যাটাগরিতে—শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর দুটি পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার।
শুধু তা-ই নয়, ছবিটি ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সমালোচকদের রায়ে সেরা ছবির ফিপরেস্কি পুরস্কার সহ মরক্কোর মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও পাকিস্তানের কারা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পায় ।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন
এই সিনেমায় ফুটে উঠেছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, এই সময়ে
পটভূমিতে যুদ্ধ ও ধর্মের কারণে বিচ্ছিন্ন একটি পরিবারের গল্প ।
মূল চরিত্র কিশোর আনু। তার বাবা কাজী হোমিওপ্যাথি চর্চা
করে। প্রচণ্ড ধর্মান্ধ মুসলিম কাজী। আনুর মা আয়েশা স্বভাবে ডানপিটে ছিল একসময়। বিয়ের
পর কাজীর ধর্মান্ধতার কারণে নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নেয়। আনুর ছোট বোন আসমা। চাচা
মিলনের সঙ্গে হিন্দুদের পূজা উৎসব আর নৌকাবাইচ দেখতে যায় আনু। বিষয়টি পছন্দ হয় না কাজীর,
‘হিন্দুয়ানি’
পরিবেশ থেকে উদ্ধার করতে ছেলেকে পাঠিয়ে দেয় মাদরাসায়। নিঃসঙ্গ সহপাঠী রোকনের সঙ্গে
আনুর বেশ খাতির হয়ে যায়।
এরই মধ্যে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। চরিত্রগুলোর
নিজেদের মনোজগতের সঙ্গে যুদ্ধ আর স্বাধীনতার যুদ্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে।
এছাড়াও চলচ্চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা
উপাদান—লোকগান,
ধর্মীয় বাহাস, নৌকাবাইচ, ভাষা ও উচ্চারণ, গ্রামীণ মেলা, নকশি কাঁথা, মাটির তৈরি পাখি,
চিত্রকর্ম ও পুঁথিপাঠ। সব মিলিয়ে ‘মাটির ময়না হয়ে উঠেছে অনবদ্য এক দৃশ্যকাব্য।
চলচ্চিত্র জুড়ে ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি থাকলেও সেগুলো
একটি কিশোরের মানবিক অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ